বর্ণমালা নিউজ ডেস্কঃ
আন্দোলন কিংবা নির্বাচন সবকিছুতেই সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে রাজপথের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। সমমনা দল ও জোটের সঙ্গে একমত হওয়া, এমনকি নিজের দল পুনর্গঠনের ক্ষেত্রেও কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না দলটি। সরকারবিরোধী আন্দোলনে মাঠে থাকলেও বিএনপির সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা নিয়েও ক্ষুব্ধ ও হতাশ সমমনা দলগুলো। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রেও সুনির্দিষ্ট কোনো কৌশল নির্ধারণ করা সম্ভব হচ্ছে না। আন্দোলনের নামে রাজপথে মাঝে-মধ্যে যেসব কর্মসূচি চলছে- সেগুলোও নামকাওয়াস্তেই। ভিতরে ভিতরে দলের সিনিয়র নেতাদের মধ্যেও হতাশা বিরাজ করছে। পদ-পদবি হারানোর ভয়ে কেউ কিছু বলতে পারছেন না। তারা এখন তাকিয়ে আছেন দলের হাইকমান্ড তারেক রহমানের দিকে। বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলোর মাধ্যমে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, আন্দোলনের কৌশল নিয়ে রীতিমতো বিপাকে আছে বিএনপি। যুৎসই কৌশল নির্ধারণ করা সম্ভব হচ্ছে না দলটির পক্ষে। গতানুগতিক কিছু কর্মসূচি ছাড়া আর কোনো কর্মসূচিতে যাচ্ছে না বিএনপি। গত কয়েক বছরে যত আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে- তার সবই ছিল সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাহীন। গত বছরের ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে সবচেয়ে বড় মহাসমাবেশের আয়োজন করলেও সেটি ছিল ‘রুটিন ওয়ার্কের’ মতোই কর্মসূচি। এর আগে বা পরে কোনো পরিকল্পনাই ছিল না তাদের। ফলে লাখ লাখ নেতা-কর্মীর সমাবেশ মাত্র ১০ মিনিটেই পুলিশ ছত্রভঙ্গ করে দিতে সক্ষম হয়। এর পরই শুরু হয় সারা দেশে পুলিশের মামলা ও ধরপাকড়। বড় নেতারা অধিকাংশই গা ঢাকা দেন। কেউ কেউ দেশ ছেড়েও গা বাঁচান। আবার অনেকের বিরুদ্ধে বাড়িঘরে থেকে স্বেচ্ছায় পুলিশের হাতে ধরা দিয়ে কারাবাসে যাওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। কোনো প্রতিরোধমূলক কর্মসূচি না থাকায় যথারীতি ৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের প্রতিবাদে চোখে পড়ার মতো কোনো কর্মসূচিও দেয়নি দলটি। ফলে নেতা-কর্মীরা ধরেই নিয়েছেন, আগামী পাঁচ বছর মেয়াদের জন্যও নিশ্চিত হয়ে যায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। হতাশা, ক্লান্তিতে ঘিরে ধরে নেতা-কর্মীদের। এরপর দীর্ঘ চার মাস পার হয়ে গেলেও এখনো পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়নি বিএনপির পক্ষে। ফলে নেতা-কর্মী-সমর্থকরা এখনো পর্যন্ত বুঝতে পারছেন না, বিএনপি কী করবে বা কী করতে যাচ্ছে। বিএনপি কি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন অব্যাহত রাখবে? নাকি এখন সংগঠন পুনর্গঠন করবে- এ ব্যাপারেও কোনো সিদ্ধান্ত নেই। কোনো কোনো নেতা মাঝেমধ্যে দলের জাতীয় কাউন্সিলের কথা বলেন। দল পুনর্গঠনের কথাও বলে থাকেন। কিন্তু কার্যত কোনো উদ্যোগই দেখা যাচ্ছে না। ফলে চলতি বছর দলের জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠানও অনিশ্চিত। এ ছাড়া জাতীয় স্থায়ী কমিটিসহ নির্বাহী কমিটির শূন্যপদগুলো পূরণ করে সংগঠনকে গতিশীল করার উদ্যোগও ঝিমিয়ে পড়েছে। এসব নিয়েও দলটিতে রয়েছে এক ধরনের সিদ্ধান্তহীনতা।
জানা যায়, জাতীয় নির্বাচনের পর সবচেয়ে বড় অনিশ্চয়তা ও সিদ্ধান্তহীনতা দেখা দেয় স্থানীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয় নিয়ে। বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত গত বছর জাতীয় নির্বাচনের আগে নেওয়া হলেও সম্প্রতি উপজেলা, পৌরসভাসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলের নীতি-নির্ধারকদের ভিতরেই বিভক্তির সৃষ্টি হয়। অবশেষে দলের হাইকমান্ডের হস্তক্ষেপে তার সমাধান হয়। তিনি নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত অব্যাহত রাখেন। কিন্তু এর পরও দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে বহিষ্কারাদেশ মাথায় নিয়েও সাম্প্রতিক প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির শতাধিক স্থানীয় নেতা অংশ নেন। শত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও সাতজন উপজেলা চেয়ারম্যান পদে এবং অন্য দুজন ভাইস-চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন। দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার দায়েও ইতোমধ্যেই ৬৩ জন স্থানীয় নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এই বহিষ্কারাদেশের তোয়াক্কা না করেই তারা আগামী ২১ মে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।
এ বিষয়ে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, বর্তমান ফ্যাসিস্ট সরকারের অধীনে বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন অবাধ কিংবা সুষ্ঠু হবে বলে দেশে-বিদেশে কেউ বিশ্বাস করে না। এমনকি আওয়ামী লীগের লোকেরাও এখন বিশ্বাস কওে না। ফলে সাম্প্রতিক উপজেলা নির্বাচনে দেখা গেছে যে, আওয়ামী লীগের লোকেরাও এ নির্বাচনে ভোট দিতে যায়নি। সর্বস্তরের জনগণ এই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে। তাছাড়া বিএনপির নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত আগে থেকেই বহাল রয়েছে। এখনো আছে। এ সরকার যতদিন ক্ষমতায় থাকবে ততদিনই বিএনপি এদের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না। এ জন্যই নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন চলছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে বিএনপি সম্প্রতি সবচেয়ে বেশি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে বলে জানা গেছে। বিএনপি নির্বাচনের আগে টানা দুই বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু নির্বাচনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুরোপুরি পাল্টে যায়। আর তাই বিএনপির মধ্যে সৃষ্টি হয় এক ধরনের হতাশা। নির্বাচনের প্রাক্কালে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি. হাসকে দলের অনেক নেতা ‘অবতার’ হিসেবেও আখ্যা দিয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচনের পর তারাই আবার তাকে নিয়ে চরম হতাশা প্রকাশ করেন। এমন অবস্থায় বিএনপি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নতুন কোনো কৌশল অবলম্বন করবে কি না- সে ব্যাপারেও কোনো সিদ্ধান্ত আছে বলে কেউ জানেন না। সম্প্রতি প্রতিবেশী ভারত বিরোধিতার কৌশল নিতে গিয়েও আবার পিছিয়ে এসেছে দলটি। কেউ কেউ আবার চীনসহ পূর্বমুখী কূটনীতির দিকেও গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলছেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিএনপি কোন পথে এগোবে এ নিয়েও দলের অভ্যন্তরে নানা জটিলতা রয়েছে বলে জানা গেছে।
তবে এ সম্পর্কে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ও দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিএনপির আন্তর্জাতিক কৌশল হলো- ‘সর্বমুখী কৌশল’। কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়, সবার সঙ্গেই বন্ধুত্ব। তবে বাংলাদেশের জনগণও পর্যবেক্ষণ করছেন- গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কোন দেশের কী ভূমিকা রয়েছে। কারা বাংলাদেশ ও তার জনগণের সঙ্গে কী আচরণ করছে। কাজেই সময় মতো তারাও এ ব্যাপারে তাদের সিদ্ধান্ত দেবেন। অন্যদিকে রাজপথের আন্দোলনের শরিক সমমনা দল ও জোটগুলোর সঙ্গে ঐক্য নিয়েও বিএনপিতে চলছে সিদ্ধান্তহীনতা। বিএনপির অনেকেই মনে করছেন, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব একটি ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফরম তৈরি করা উচিত। আবার কেউ কেউ মনে করেন, পুরনো ২০ দল বা জামায়াতের সঙ্গে তাদের ঐক্য পুনর্বিন্যাস করা উচিত। আবার নীতি-নির্ধারকদের কেউ কেউ ‘একলা চলো নীতি’ অবলম্বনের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন। এ অবস্থায় গণতন্ত্র মঞ্চসহ সমমনা দলগুলোর নেতারা রয়েছেন ধোঁয়াশায়। এ ব্যাপারে গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষস্থানীয় নেতা ও নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, বিএনপিকে সবার সঙ্গে আলোচনা করেই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মতো একটা ভয়ংকর ফ্যাসিস্ট সরকারকে হটাতে হলে এসব ‘দশটা-পাঁচটা অফিস করার মতো’ রুটিন-ওয়ার্ক আন্দোলনে কাজ হবে না। এ জন্য আন্দোলনমুখী সব রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতার মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে।
বর্ণমালা নিউজ।