বর্ণমালা নিউজ ডেস্কঃ
৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর পেরিয়ে গেছে তিন মাস। মামলা-হামলা-গ্রেফতারে জর্জরিত বিএনপি নির্বাচনোত্তর অনেকটাই নীরব সময় পার করছে। বলতে গেলে দলটি এখন দম নিচ্ছে। পরবর্তী কৌশল নির্ধারণ নিয়ে দলের অভ্যন্তরে আলোচনা চলছে। নেতাকর্মীদের আবার চাঙ্গা করতে নেয়া হয়েছে নানামুখী উদ্যোগ। রমজানজুড়ে ইফতার মাহফিল কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সারা দেশে কারামুক্ত নেতাকর্মীদের সংবর্ধনা দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পাশেও দাঁড়িয়েছে দলটি। জানা গেছে, পবিত্র ঈদুল ফিতরের পর নতুন নির্বাচনের দাবিতে আবার মাঠের কর্মসূচিতে সক্রিয় হবে বিএনপি। যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের সাথে আলোচনা করে নতুন কর্মসূচি দেয়া হবে। একই সাথে চলতি বছর শেষে কাউন্সিলের চিন্তাও করছে দলটি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান আলাপকালে বলেন, বিএনপির আন্দোলনের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে এ দেশের ভোটবঞ্চিত জনগণের ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা, দেশে একদলীয় শাসনের পরিবর্তে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা। এই লক্ষ্য থেকে বিএনপি বিন্দুমাত্র পিছপা হয়নি। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের যে আন্দোলন চলছে, সেটি অব্যাহত থাকবে। বিএনপি রাজপথে থাকা সব বিরোধী দলকে সাথে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে এই সংগ্রাম চালিয়ে যাবে।
সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি ও এর মিত্রদের দীর্ঘ আন্দোলন ও নির্বাচন বর্জনের মধ্য দিয়ে গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হয়। বিরোধীরা নির্বাচন বর্জন করলেও টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতার রশি ধরে রাখতে আওয়ামী লীগকে তেমন বেগ পোহাতে হয়নি। বিএনপির অভিযোগ, নির্বাচনের আগে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ ২৭ হাজারের অধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে জোর করে ওই ভোট করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বিএনপির দাবি, তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ একতরফা ও আসন ভাগাভাগির ওই নির্বাচন বর্জন করেছে। এর ফলে ক্ষমতাসীনদের নৈতিক পরাজয় এবং বিএনপির নৈতিক বিজয় হয়েছে।
তবে বিএনপির সাথে আন্দোলনে থাকা দলগুলো নির্বাচন পরবর্তী অভ্যন্তরীণ আলোচনায় রাজপথের দীর্ঘ আন্দোলনে সরকারের পতন না হওয়ায় বিএনপিকে আন্দোলনের সফলতা-ব্যর্থতা মূল্যায়নের তাগিদ দেয়। নির্বাচনের পর সিরিজ বৈঠকে বিএনপিকে ওই তাগাদা দেন তারা। সেখানে সংসদ বাতিল ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্তও নেয় বিএনপি ও যুগপতের শরিকরা। তবে নির্বাচনের পর বিএনপির অগ্রাধিকার ছিল কারাবন্দী নেতাদের আগে জামিনে মুক্ত করা। তাই কৌশলের অংশ হিসেবে নেতাদের কারামুক্তিতে ঝামেলা এড়াতে সরকারবিরোধী বড় কোনো কর্মসূচিতে যায়নি দলটি। গত তিন মাসে বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের কারাবন্দী প্রায় সবাই জামিনে কারামুক্ত হয়েছেন। ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ ঘিরে পুলিশের সাথে সংঘর্ষের ঘটনায় বিভিন্ন মামলায় আত্মগোপনে থাকা নেতারাও এরই মধ্যে জামিন পেয়ে দলীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন। এমন প্রেক্ষাপটে সরকারবিরোধী আন্দোলনের পর সারা দেশে ঝিমিয়ে পড়া সংগঠন ও হতাশাগ্রস্ত নেতাকর্মীদের চাঙ্গা ও উজ্জীবিত করতে রমজানে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত ইফতার মাহফিল করার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। নেতাকর্মীদের ব্যাপক উপস্থিতির মধ্য দিয়ে দেশব্যাপী মহানগর, জেলা ও উপজেলা এবং ঢাকা মহানগরে ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত এসব ইফতার মাহফিল করছে দলটি। সেখানে দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংগঠনের সদ্য কারামুক্ত নেতাদের ফুলের মালা পরিয়ে সংবর্ধনা দেয়া হয়েছে। নেতাকর্মীদের উৎসাহিত করতে কেন্দ্রীয় কর্মসূচি ছাড়াও সাংগঠনিক বিভিন্ন জেলায় ইফতার মাহফিলে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভার্চুয়ালি উপস্থিত থেকে বক্তব্য দিয়েছেন। এছাড়া ঈদ উপলক্ষে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে গুম-খুন ও পঙ্গুত্বের শিকার বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের কয়েক হাজার নেতাকর্মীর পরিবারে এবারো দলের পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। এসব কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সংগঠনকে পুনরায় চাঙ্গা করার চেষ্টা করছে বিএনপি।
এদিকে নির্বাচনের পর দলীয়ভাবে কিছু কর্মসূচি পালিত হলেও যুগপৎভাবে কোনো কর্মসূচি হয়নি। তবে মিত্রদের সাথে বিএনপির নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। এই সময়ে বিএনপি সংসদ বাতিল, একদফা দাবি এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে দলীয়ভাবে কালো পতাকা মিছিল, লিফলেট বিতরণ ও গণসংযোগের মতো কর্মসূচি পালন করেছে। দলগতভাবে অনুরূপ কর্মসূচি করেছে যুগপতের শরিকরাও। তবে ঈদের পরে সরকারবিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচি ও কৌশল কী হবে, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে বিএনপি। সম্প্রতি স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ নিয়ে একদফা আলোচনা হয়েছে, তবে সিদ্ধান্ত হয়নি।
জানা গেছে, ঈদের পর এ নিয়ে যুগপতের শরিকদের সাথে বৈঠকে বসবে বিএনপি। সেখানে নতুন কর্মসূচির বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। নির্বাচনের পরে গণতন্ত্র মঞ্চসহ শরিকদের সাথে বিএনপির পৃথক বৈঠক হলেও কর্মসূচির বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সেখানে মূলত বিগত আন্দোলনের সফলতা-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-বিশ্লেষণ হয়। গণতন্ত্র মঞ্চের পক্ষ থেকে ভবিষ্যতের স্বার্থে বিএনপিকে বিগত আন্দোলন সফল না হওয়ার একটি সঠিক ও যথাযথ মূল্যায়ন করার তাগাদা দেয়া হয়। মঞ্চের নেতারা মনে করেন, পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়নের ভিত্তিতে পরবর্তী করণীয় নির্ধারিত না হলে আগামীর আন্দোলনে সফলতা নিয়েও সংশয় থেকে যাবে। এছাড়া সরকারি চাপ ও প্রলোভন উপেক্ষা করে রাজপথে একদফার আন্দোলনে সক্রিয় থাকায় বিএনপির হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে শরিকদের ধন্যবাদ জানানো হয়।
এদিকে রাজপথের কর্মসূচিতে সরকারের পতন না হওয়ায় নির্বাচনের পরপরই আন্দোলনের সাফল্য-ব্যর্থতার মূল্যায়ন শুরু করে বিএনপির হাইকমান্ড। সীমিত পরিসরের ওই মূল্যায়নে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গসংগঠনগুলো রাজপথে কার্যকর ও প্রত্যাশিত ভূমিকা না রাখায় সরকারবিরোধী আন্দোলনে চূড়ান্ত সাফল্য আসেনি বলে মনে করে দল। এমন মূল্যায়নের ভিত্তিতে অঙ্গসংগঠনের কমিটি ভেঙে দেয়াসহ বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেই সিদ্ধান্তের আলোকে গত ১ মার্চ ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন আংশিক কমিটি গঠন করা হয়। একই সাথে গঠন করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের নতুন আংশিক কমিটিও।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাতীয় কাউন্সিল নিয়েও ভাবছে বিএনপি। দীর্ঘ প্রায় আট বছরেও কাউন্সিল হয়নি দেশের অন্যতম বৃহৎ এই রাজনৈতিক দলটির। এমন প্রেক্ষাপটে কাউন্সিল করা উচিত বলে মত আসছে বিএনপিতে। এ নিয়ে স্থায়ী কমিটির মিটিংয়ে একাধিকবার আলোচনাও হয়েছে। সর্বশেষ গত ৪ মার্চ স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে কাউন্সিল নিয়ে আলোচনা হয়। তখন হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে বলা হয়, আরো আলোচনা করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। জানা গেছে, সারা দেশের নেতাকর্মীরা কারামুক্ত এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসায় চলতি বছরের শেষ দিকে বিএনপি তাদের সপ্তম জাতীয় কাউন্সিল করতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে। দলটির নেতারা বলছেন, কাউন্সিল করতে হলে জেলার মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিগুলো নতুন করে করতে হবে, অঙ্গ সংগঠনগুলোও পুনর্গঠন করতে হবে। ঈদের পরে পর্যায়ক্রমে এসব কাজ শুরু হতে পারে বলে জানা গেছে।
বর্ণমালা নিউজ।